দখিনের খবর ডেস্ক ॥ ভেজাল খাদ্যের কারণে হুমকির মুখে দেশের জনস্বাস্থ্য। প্রায় সব খাদ্যেই হরহামেশা ভেজাল দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন সময় অভিযানে গ্রামের সহজ-সরল মুড়ি তৈরিকারী থেকে শুরু করে বড় বড় ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত খাদ্যেও ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। মাছ ও শাক-সবজিতে ফরমালিন, বিষাক্ত জেলি ও কীটনাশক, ভোজ্য তেলে অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট, মসলায় রং, ইট ও কাঠের গুঁড়া, মুড়িতে ইউরিয়া, পানিতে কলেরার জীবাণু, গরুর দুধে পাউডার ও পানি মিশ্রণ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মিষ্টি ও বেকারি পণ্য তৈরি, হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারে বাসি-পচা ও পোড়া তেল ব্যবহার ইত্যাদি নানা উপায়ে হাতের কাছের সব খাবারেই প্রতিদিন ভেজাল মেশানো হচ্ছে। এমনকি ভেজাল থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশুখাদ্যও। যা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সারা দেশ থেকে সংগৃহীত ৪৩টি ভোগ্য পণ্যের মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে তার মধ্যে ৪৩ ধরনের পণ্যেই ভেজাল পাওয়া যায়। ওসব নমুনা জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। এ ক্ষেত্রে ভেজালের পরিমাণ গড়ে ৪০ শতাংশ। তার মধ্যে ১৩টি পণ্যে ভেজালের হার প্রায় শতভাগ। মূলত ভোগ্য পণ্যে কী পরিমাণ ভেজাল আছে তা দেখতে এই পরীক্ষা করা হয়। তাছাড়া নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর ২০১৯ সালে বাজার থেকে মোট ৩ হাজার ৫৬৬টি খাদ্য নমুনা সংগ্রহ করে তা থেকে ২ হাজার ৪৬২টি পরীক্ষাগারে পাঠায়। পরীক্ষা শেষে তার থেকে ৩৭৪টি খাদ্য নমুনায় ভেজাল পাওয়া যায়। অর্থাৎ বাজারের ১৫ শতাংশ খাবারেই ভেজাল পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে খাদ্য উৎপাদন যতো বেড়েছে, নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির চ্যালেঞ্জও ততো বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) তথ্য মতে, শুধু ট্রান্সফ্যাট ঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ডাব্লিউএইচও’র ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে ৫ হাজার ৭৭৬ জন মানুষ মারা যায়। খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা পিএইচও, যা ডালডা বা বনসপতি ঘি নামে সুপরিচিত। পিএইচও বা ডালডা সাধারণত বেকারি পণ্য, প্রক্রিয়াজাতকৃত ও ভাজা-পোড়া স্ন্যাকস এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি এক গবেষণায় ঢাকার পিএইচও নমুনার ৯২ শতাংশে ডাব্লিউএইচও সুপারিশকৃত ২ শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্সফ্যাটি এসিড) পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচও নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, যা ডাব্লিউএইচওর সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি। সূত্র আরো জানায়, নিরাপদ খাদ্যের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একমাত্র প্রতিষ্ঠান নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষও নানা সমস্যা নিয়ে চলছে। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব কোনো ল্যাব নেই। নেই খাদ্যের তাৎক্ষণিক মান যাচাইয়ের উপকরণও। ফলে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর অডিট করতে হচ্ছে। বিগত ২০১৯-২০২০ সালে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে মোট ১৩৪টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। ওই সময় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পোড়া তেল ব্যবহার, বাসি-পচা খাবার বিক্রিসহ নানা অপরাধে ১৪১ জন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হয়। এদিকে এ প্রসঙ্গে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক ড. সহদেব চন্দ্র সাহা জানান, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এখন শুধুমাত্র হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতেই অভিযান পরিচালনা করে। আর অন্যান্য খাদ্য পরীক্ষা করতে বাজার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট ল্যাবে পাঠানো হয়। অন্যদিকে ভেজাল খাদ্যে জনস্বাস্থ্যের হুমকি প্রসঙ্গে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদুল কবির জানান, দেশে এখন নানা উপায়ে খাদ্যে ভেজাল মিশছে। ফলে তাৎক্ষণিক কিছু রোগ হয়। যেমন- ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, বমি হওয়া ইত্যাদি। তাছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে হৃদরোগ, কিডনি রোগ, ব্রেনের সমস্যা ও ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ফরমালিনে লিভার, কিডনি ড্যামেজ হয়ে যায়। খাদ্যে নানা ধরনের কেমিক্যাল ও প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া অনেক খাবারে হেভি মেটালও থাকে। ওসব উপাদান শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনে।
Leave a Reply